সিরিয়া যুদ্ধের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতঃ (প্রথম পর্ব)

মূলত খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০০ বছর থেকে সিরিয়ার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। সিরিয়াতে ইসলাম আসার সময়, সিরিয়া মূলত ‘শাম’ নামে পরিচিত ছিল এবং শাম এর বৃহত্তর অংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন ও দখলদার ইসরাইল। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফতের সময় সিরিয়া রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। এরপর হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ও হযরত আবু ওবায়দা (রাঃ) এর নেতৃত্বে একে একে পুরো বৃহত্তর সিরিয়া (শাম) ইসলামিক খেলাফতের অধীনে আসে এবং দলে দলে সেখানকার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। খুলাফায়ে রাশেদিনদের পরে  ১০৯৮ সাল পর্যন্ত জাজিরাতুল আরব (সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরাত,কাতার, বাহরাইন ও ওমান) ভিত্তিক উমাইয়া বংশ , আব্বাসীয় বংশ ও মিশরভিত্তিক ফাতেমীয় রাজতন্ত্রের অধীনে শাসিত হয়। ১০৯৮ থেকে ১১৮৯ সাল পর্যন্ত ক্রুসেড যুদ্ধের সময় বর্তমানের মূল সিরিয়াসহ বৃহত্তর শামের বিভিন্ন অংশ জার্মান, ইংরেজ, ইতালি ও ফ্রান্সের দ্বারা শাসিত হয়। পরবর্তীতে সেলজুক, আইয়ুবি, মামলুকদের হাত ঘুরে এই ভূখণ্ড ১৫১৬ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর মূলসিরিয়াসহ বৃহত্তর সিরিয়া ব্রিটিশ ও ফ্রান্স সেনাবাহিনীর অধীনে আসে। এবং এই দুই সাম্রাজ্যবাদী জাতি তখন একটা চুক্তির মাধ্যমে এর উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে। যদিও ১৯২০ সালে হাশেমি পরিবারের ফয়সাল নামক একজন তল্পিবাহককে আমীর করে একটি কয়েকমাসের ক্ষণস্থায়ী ‘সিয়িয়ান রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু তা পরে আবার ‘ফ্রান্স ম্যান্ডেট’ এর অধীনে চলে আসে।


এমনিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ফ্রান্স সেনাবাহিনী এবং সিরীয় জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে দফায় দফায় কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং ১৯৩৬ সালে সিরীয় জাতীয়তাবাদীদের ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাধীনতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। এবং হাসিম আল তাসিকে প্রথম রাষ্ট্রপতি করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে তা আবার ফ্রান্স সেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ১৯৪৬ সালে এপ্রিল মাসে সেনা প্রত্যাহার করে প্রজাতন্ত্রী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।


১৯৪৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত শুধু আরব ইসরাইল যুদ্ধ (১৯৪৮) আর ঘন ঘন সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস।  এর মাঝে সুয়েজ খাল নিয়ে ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় আরব ইসরাইল যুদ্ধের পরে সিরিয়া রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) এর সাথে মৈত্রী চুক্তি করে। এর ফলে সিরিয়া রাশিয়া থেকে সমর সরঞ্জাম এর সাথে সমাজতন্ত্রের চেতনাও আমদানী করতে সক্ষম হয়। ১৯৫৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি সিরিয়া এবং মিশর ‘সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র’ এর ঘোষণা দেয় এবং ১৯৬১ সালে তা ভেঙ্গে যায়। এর মাঝে সিরিয়াতে আরব জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক মতবাদ ‘বাথিজম’ এর উত্থান ঘটে এবং একে কেন্দ্র করেই সিরিয়ায় শাসন ব্যবস্থা কায়েম হতে থাকে। ১৯৬৬ সালে সালেহ জাদিদ (হাদ্দাদিন গোত্রের), মুহাম্মদ উমরান (খাইয়্যাতিন গোত্রের) এবং হাফিজ আল আসাদ (কাল্বিয়্যা বা বনু কাল্ব গোত্রের) মিলে আরেক দফা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হাতে নেয়। এবং আশ্চর্যজনকভাবে তিনজন অফিসারই শিয়া নুসাইরিয়া আকিদার। এরমাঝে ১৯৬৭ সালে সিরিয়া আবারও ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং গোলান মালভূমি হাতছাড়া হয়। এই বিষয়কে ভিত্তি করে  যুদ্ধকালীন সামরিক প্রধান হাফিজ আল আসাদ ও অপর সামরিক শাসক সালাহ জাদিদের সাথে মতপার্থক্য প্রকট হয়। যার ফলস্বরূপ, এক রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭০ সালে হাফিজ আল আল আসাদ ক্ষমতায় আসীন হয় এবং ২০০০ সালে তার মৃত্যুর পর ৩০ বছরের শাসন শেষে তার ছেলে বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আসে। উল্লেখ্য, এ নুসাইরিয়া সম্প্রদায় সিরিয়ার মাত্র ১৩% শিয়ার একটি অংশ।


মূলত ১৯৭০ সালে হাফিজ আল আসাদের ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে সিরিয়া নামক গোটা ভূখণ্ডে ইসলাম আসার পরের ইতিহাসে প্রথম কোন ব্যক্তি সিরিয়ার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল যে কিনা আরবদের গোত্র পরিচয়ের দিক থেকে বনু কাল্ব গোত্রের এবং আকিদাগত দিক থেকে শিয়া নুয়াইরিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং জন্মগতভাবে পাহাড়ি উপত্যাকার একটি গ্রাম কারদাহা থেকে । আর ইমাম মাহদী আঃ এর আগমনের পূর্বে সিরিয়াতে সুফিয়ানী নামক যে অত্যাচারী বাদশার আবির্ভাব হবে সেও কিন্তু বানু কাল্ব গোত্রের লোক হবে এবং একটি পাহাড়ী উপত্যকা থেকেই। তাই ভবিষ্যৎ ইসলামের ইতিহাসের জন্য বানু কাল্ব গোত্রের লোকজন কেমন হবে তাই আমার আলোচনার বিষয় বস্তু।

২০১১ সালে আরব বসন্ত উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি বিরাট নিয়ে আসে। এক নিমিষেই আরব বিশ্বের অহংকারী ও প্রতাপশালী রাজাদের ক্ষমতার মসনদের টনক নড়ে যায়। একে একে ক্ষমতা হারান তিউনেসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গদ্দাফি, মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। কেবল ব্যাতিক্রম ঘটে সিরিয়ায়, রক্ত পিপাসু বাসার আল আসাদের কাছে হেরে যায় আরব বসন্ত।

২০১১ সালে সিরিয়ার সাধারণ মানুষ যখন আসাদের পতনের জন্য রাস্তায় নেমে আসে, তখন রক্ত পিপাসু আসাদ অস্ত্র নিয়ে জনগণের উপর চরাও হয়। শুরু হয় সিরিয়ার যুদ্ধ, সিরিয়ার আসাদ বিরোধী জনগণের কাছে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। আসাদ বিরোধী জনগণের সাথে যোগ দেয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ-FSA, ইরাকের জিহাদী গোষ্ঠী ইসলামিক ইস্টেট, সিরিয়ার জিহাদী গোষ্ঠী জাবাহাত আল নুসরা, সৌদি - তুরস্ক পন্থী আহরার আল শাম, জাইশুল ইসলাম সহ আরো অনেক গুলো দল।  অপর দিকে প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয় রাশিয়া, ইরানের IRGC, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাক ও আফগানিস্তানের শিয়া মিলিশিয়ারা।
প্রথম দিকে আসাদ বিরোধীরা একে একে দখল করে নেয় আলেপ্পো, রাক্কা, ইদলিব, দারা, দেইর আল জুর, পালমিরা, এছাড়াও রাজধানী দামেস্কের ও হোমস প্রদেশের কিছু এলাকা।

হঠাৎ করে ২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ার দুই জিহাদী গোষ্ঠী ইসলামিক ইস্টেট ও জাবাহাত আল নুসরার বিরোধ প্রকাশ পেতে শুরু করে। এই বিরোধের জেরে ইরাকের জিহাদী গোষ্ঠী ইসলামিক ইস্টেট তাদের নিয়ন্ত্রিত ইরাক ও সিরিয়ার এলাকায় খেলাফত ঘোষণা করে। এর পর তাদের উপর চরাও হয় যুক্তরাষ্ট্র, কুর্দি বাহিনী YPG, SDF, ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়ারা।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে হঠাৎ করেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্লাদিমির পুতিন বাসার আল আসাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। রাশিয়ার প্রকাশ্য অংশ গ্রহনের ফলে পুরো যুদ্ধের মোড়ই ঘুরে যায়। ২০১৬ সালে তুরস্কও সরাসরি সিরিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাদের উদ্দেশ্য ছিল কুর্দি বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করা। ২০১৭ সালে এসে আসাদ সরকার সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকাই পুনঃদখল নিতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে নতুন করে যুদ্ধের গুঞ্জন শুরু হয় ইরাকের কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে।

(দ্বিতীয় পর্বের লিংকঃhttps://islamicastrolgy.blogspot.com/2018/02/blog-post_59.html?m=1

Popular posts from this blog

ইমাম মাহদী কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন? আমরা তাকে কোন দলে খুঁজে বের করব?

ইমাম মাহদীর আবির্ভাব হবে ২০২৮ সালে (ইনশাল্লাহ)

ফোরাত নদীর তীরে সোনার পাহাড় কোথায় এবং কবে ভেসে উঠবে? (২০২৩ সালে ইনশাল্লাহ)